তরুণ রাজনৈতিক নেতাদের চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা: আগামীর নেতৃত্ব কেমন হবে

বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে তরুণদের অংশগ্রহণ এখন আর কেবল একটি অপ্রাসঙ্গিক ধারণা নয়, বরং এটি দেশের ভবিষ্যৎ পথচলার এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের মতো প্রাজ্ঞ ব্যক্তির ভাষ্যমতে, “রাজনীতিতে তরুণদের আরও সক্রিয় হতে হবে”। এই আহ্বান কেবল একটি পরামর্শ নয়, বরং রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তনের এক কৌশলগত দিকনির্দেশনা। সাম্প্রতিক ২০২৪ এর গণঅভ্যুত্থান, ২০১৮ এর কোটা সংস্কার আন্দোলন এবং নিরাপদ সড়ক আন্দোলন প্রমাণ করেছে যে বাংলাদেশের তরুণ সমাজ কেবল ক্ষোভ প্রকাশে সীমাবদ্ধ নয়, বরং সুসংগঠিত এবং গঠনমূলক পরিবর্তনের ক্ষমতা রাখে।
‘তরুণ’ বলতে শুধুমাত্র বয়সের গণ্ডিকে বোঝানো হয় না, বরং এটি একটি মানসিকতা, যা নতুনত্বের প্রতি আকর্ষণ, উদ্ভাবনী শক্তি এবং সংস্কারের আকাঙ্ক্ষা ধারণ করে। তরুণ নেতৃত্ব সাধারণত গতিশীল, প্রযুক্তি-সচেতন এবং নৈতিক মূল্যবোধের প্রতি গভীরভাবে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়। তারা দীর্ঘমেয়াদী ক্ষমতার চেয়ে দ্রুত এবং কার্যকর পরিবর্তনের ওপর বেশি জোর দেয়, যা অনেক সময় প্রচলিত রাজনৈতিক কাঠামোর সঙ্গে সংঘাত তৈরি করে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তরুণ নেতৃত্বের উত্থান নতুন কোনো ঘটনা নয়।
ফিনল্যান্ডের সানা মারিন, নিউজিল্যান্ডের জাসিন্ডা আরডার্ন, ফ্রান্সের ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ এবং চিলির গ্যাব্রিয়েল বরিচ, এরা প্রত্যেকেই তরুণ বয়সে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব নিয়ে নিজেদের দক্ষতা প্রমাণ করেছেন। একই পথে হাটছেন আমেরিকান মুসলিম তরুণ জেহরান মামদানি। তাঁরা প্রচলিত রাজনৈতিক ধারা ভেঙে নতুনত্ব এনেছেন এবং পরিবেশবান্ধব নীতি, প্রযুক্তিগত আধুনিকীকরণ এবং মানবিক নেতৃত্বের ওপর ভিত্তি করে তাঁদের রাষ্ট্র পরিচালনা করেছেন। এই নেতারা প্রমাণ করেছেন যে বয়স নয়, বরং দূরদর্শিতা এবং নীতিগত দৃঢ়তাই একটি জাতিকে অগ্রগতির পথে চালিত করতে পারে।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস তরুণদের সাহসিকতা এবং আত্মত্যাগের গল্পে সমৃদ্ধ। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররাই বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় জীবন উৎসর্গ করেছিল। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধেও তরুণ ছাত্র-যুবকরা প্রধান চালিকাশক্তি ছিল, যারা কেবল সশস্ত্র সংগ্রামে নয়, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনেও নেতৃত্ব দিয়েছে। সাম্প্রতিক কোটা সংস্কার ও নিরাপদ সড়ক আন্দোলন এবং সর্বশেষ চব্বিশের গণঅভ্যুত্থান প্রমাণ করেছে, তরুণরা সুসংগঠিতভাবে দাবি জানাতে সক্ষম, যেখানে প্রচলিত রাজনৈতিক দলগুলো তাদের আকাঙ্ক্ষা পূরণে ব্যর্থ হয়েছে। এই ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট দেখায় যে বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্ম কেবল প্রতিবাদী নয়, বরং জাতি গঠনে প্রগতিশীল শক্তির প্রমাণ।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় তরুণ নেতৃত্বের উত্থান এখনো নানাবিধ কাঠামোগত এবং সামাজিক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরে সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া এবং পদোন্নতি এখনো বয়োজ্যেষ্ঠ নেতাদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। এখানে ক্ষমতা ভাগাভাগি করতে অনিচ্ছা, নেপোটিজম (স্বজনপ্রীতি), এবং আনফেয়ার পেট্রোনেজ (অনিয়মতান্ত্রিক পৃষ্ঠপোষকতা)-এর মতো বিষয়গুলো তরুণদের জন্য বাধা সৃষ্টি করে। অনেক সময় দেখা যায়, যোগ্যতার চেয়ে রাজনৈতিক আনুগত্য বা পারিবারিক পরিচিতি বেশি গুরুত্ব পায়। এছাড়া, রাজনীতিতে টিকে থাকতে হলে অনেক সময় বিপুল আর্থিক সংস্থান প্রয়োজন হয়, যা অধিকাংশ তরুণের জন্য সম্ভব নয়। নির্বাচনের খরচ, রাজনৈতিক প্রচারণার ব্যয় এবং দলের ভেতরে পদ পেতে বিভিন্ন ধরনের আর্থিক লেনদেনের সংস্কৃতি তরুণদের জন্য একটি বড় বাধা।
বাংলাদেশের রাজনীতিকে প্রায়শই একটি ঝুঁকিপূর্ণ বা ‘নোংরা’ পেশা হিসেবে দেখা হয়। এই ধারণার কারণে অনেক মেধাবী এবং যোগ্য তরুণ এই ক্ষেত্র থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেয়। এর ফলে দেশের রাজনৈতিক প্রজ্ঞার দিক থেকে একটি বড় ধরনের ক্ষতি হয়। পরিবার থেকে অনেক সময় রাজনীতিতে যুক্ত হতে নিরুৎসাহিত করা হয়, যা তরুণদের জন্য আরেকটি মানসিক চাপ সৃষ্টি করে। তরুণদের জন্য সুসংগঠিত কোনো রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্মের অভাব রয়েছে। বিদ্যমান রাজনৈতিক দলগুলো তরুণদের জন্য যে যুব সংগঠন তৈরি করে, তা অনেক সময় মূল দলের নেতৃত্বের সংকীর্ণ স্বার্থের জন্য ব্যবহৃত হয়, যা প্রকৃত অর্থে তরুণ নেতৃত্বের বিকাশে সাহায্য করে না।
তরুণ নেতৃত্ব বিকাশের জন্য একটি সুসংগঠিত এবং বহুমুখী কৌশল গ্রহণ করা প্রয়োজন। রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত তাদের গঠনতন্ত্রে পরিবর্তন আনা এবং যুব কোটা প্রবর্তন করা, যা তরুণদের জন্য নির্দিষ্ট সংখ্যক পদ সংরক্ষিত রাখবে। এছাড়া, দলীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় তরুণদের অংশগ্রহণের সুযোগ বাড়ানো আবশ্যক। দলীয় পদোন্নতির ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা হলে যোগ্য তরুণরা উৎসাহিত হবে। শিক্ষাব্যবস্থায় নাগরিক শিক্ষা, নৈতিক নেতৃত্ব এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। ইয়ুথ পার্লামেন্ট বা ডেমোক্রেসি ক্যাম্পের মতো উদ্যোগগুলো তরুণদের হাতে-কলমে রাজনৈতিক শিক্ষা দিতে পারে এবং তাদের মধ্যে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির চর্চা গড়ে তুলতে সাহায্য করতে পারে।
সিনিয়র নেতাদের উচিত তরুণদের জন্য মেন্টরশিপ প্রোগ্রাম চালু করা। এই মেন্টরশিপের মাধ্যমে তরুণরা রাজনৈতিক কৌশল, প্রশাসনিক জ্ঞান এবং নৈতিক নেতৃত্বের মডেল সম্পর্কে শিখতে পারবে। সিনিয়র নেতারা তাদের অভিজ্ঞতা দিয়ে তরুণদের ভুল থেকে শিখতে এবং সামনে এগিয়ে যেতে সাহায্য করতে পারেন। তরুণদের প্রযুক্তি-সচেতনতাকে কাজে লাগিয়ে নতুন ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা যেতে পারে, যেখানে তারা রাজনৈতিক আলোচনা, সমস্যা সমাধান এবং নীতি প্রণয়নে অংশগ্রহণ করতে পারবে।
বাংলাদেশের প্রায় ৪ কোটি তরুণ ভোটার রয়েছে, যা দেশের জনসংখ্যার একটি বিশাল অংশ। এই বিপুল জনসংখ্যা কেবল সংখ্যাগত শক্তি নয়, এটি একটি বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সম্ভাবনা বহন করে। তরুণ নেতৃত্ব ডিজিটাল উদ্ভাবন, স্টার্টআপ ইকোসিস্টেম এবং জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতি বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। তারা দুর্নীতি ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতা হ্রাস করে বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি করতে সক্ষম। তাদের প্রযুক্তি জ্ঞান এবং নতুন ধারণা দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে নতুন গতিশীলতা আনতে পারে। তরুণরা সামাজিক ন্যায়বিচার, বৈষম্য হ্রাস এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠায় সক্রিয় ভূমিকা নিতে পারে। তাদের প্রযুক্তি-সচেতনতা সামাজিক সমস্যা সমাধানের নতুন পথ খুলে দিতে পারে, যেমন স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে প্রযুক্তি ব্যবহার করা। তরুণ নেতারা আন্তর্জাতিক সম্পর্ককে আরও শক্তিশালী করতে পারে। বিশ্বজুড়ে তরুণ নেতৃত্ব একে অপরের সঙ্গে সহজেই যোগাযোগ স্থাপন করতে পারে, যা সহযোগিতা ও পারস্পরিক বোঝাপড়া বাড়াতে সাহায্য করে।
বাংলাদেশের তরুণ নেতৃত্বের মধ্যে লুকিয়ে আছে একটি আধুনিক, দুর্নীতিমুক্ত এবং সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের স্বপ্ন। আজকের পুরোনো নেতাদের উচিত তাদের জন্য পথ তৈরি করে দেওয়া এবং একটি ইতিবাচক রাজনৈতিক পরিবেশ সৃষ্টি করা। তরুণদের ক্ষমতায়ন মানে শুধু তাদের ব্যক্তিগত ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করা নয়, এটি একটি জাতির দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়নে একটি কৌশলগত বিনিয়োগ। একসাথে কাজ করে তরুণ এবং সিনিয়র নেতারা বাংলাদেশের রাজনৈতিক কাঠামোকে আরও শক্তিশালী, স্বচ্ছ এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক করতে পারেন। এই সম্মিলিত প্রয়াস গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার এবং সামাজিক উন্নয়নের নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে তরুণদের অংশগ্রহণ শুধু প্রয়োজনীয় নয়, এটি দেশের ভবিষ্যতের জন্য অপরিহার্য।