
রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছোট্ট একটা মুখ, হাতে দুটো ফুল। চোখে ক্লান্তি আর কেমন একটা স্থির দৃষ্টি, তাকিয়ে আছে গাড়ির ভেতরে বসে থাকা আমাদের দিকে। সেদিন লাল বাতিতে থেমে থাকা গাড়ির জানালায় মুখ বাড়িয়ে সে বলল, “ফুল নেন একটা, অনেক ক্ষুধা লাগছে।”
গাড়ি চলতে শুরু করলো, কিন্তু শিশুটার সেই কথাটা মাথা থেকে সরলো না “অনেক ক্ষুধা পাইছে।” আমরা চলে যাই, কিন্তু ওরা থেকে যায়। থেকে যায় আমাদের চোখের সামনে, অথচ সবকিছু থেকে দূরে।
আমরা দেখি, তবে অনুভব করি না
ঢাকার অলিগলি, ট্রাফিক সিগনাল, বাস টার্মিনাল, লঞ্চ ঘাট, সবখানেই চোখে পড়ে এই শিশুদের। কেউ ফুল বিক্রি করছে, কেউ গাড়ির কাচ পরিষ্কার করছে, কেউ বা কেবল হাত পেতে দাঁড়িয়ে। আমরা ব্যস্ত থাকি মোবাইল স্ক্রিনে, বা চোখ ফিরিয়ে নিই “বিরক্তিকর” মনে করে।
আমাদের ঘরে জন্মানো শিশুদের শৈশব যেখানে রঙিন খেলনা, বই আর আদর দিয়ে গড়া, সেখানে পথশিশুদের শৈশব হয় কনকনে ঠান্ডায় ফুটপাথে পলিথিন পেঁচিয়ে ঘুমানো, কখনো ঝড়ের রাতে বাস স্টপে কাঁপতে থাকা।
কোথা থেকে আসে এত শিশু?
সব শিশুই তো জন্ম নেয় একটি ঘরে। তাহলে কিভাবে রাস্তায় এসে পড়ে?
এর পেছনে আছে নানান বাস্তবতা—
- নদীভাঙন, বন্যা, ঘূর্ণিঝড়ের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগে ঘর হারিয়ে পরিবার চলে আসে শহরে।
- চরম দারিদ্র্যের কারণে শহরের বস্তিগুলোতে ঠাঁই নেয়, যেখানে শিশুরা হয় পরিবারের অতিরিক্ত উপার্জনের হাতিয়ার।
- অনেকেই পারিবারিক নির্যাতন, বিবাহবিচ্ছেদ বা অভাবের চাপে ঘর ছেড়ে দেয়।
- কেউ কেউ শিশুকালে কাজ খুঁজতে এসে একসময় রাস্তাই নিজের আশ্রয় বানায়।
একসময় সেই রাস্তাই হয়ে যায় তার পুরো পৃথিবী।
শিক্ষা নেই, খাবার নেই, ঘর নেই
এই শিশুরা কখনো স্কুলের গন্ধটাও পায় না। সকালে ঘুম থেকে উঠে স্কুলব্যাগ নয়, কাঁধে তোলে ঝুড়ি, কুলি হয়, হকার হয়। ক্লাসরুম তাদের জন্য রাস্তার ফুটপাথ, আর শিক্ষক হয় জীবন নিজেই।
অনেকেই অর্ধাহারে কিংবা অনাহারে দিন কাটায়। খায় পচা ফল, বাসি ভাত কিংবা হোটেলের উচ্ছিষ্ট। অসুস্থ হলে চিকিৎসা নেই। রাতে ঘুমায় ফুটপাথে, রেলস্টেশনে, পার্কে বা দোকানের বারান্দায়।
সবচেয়ে ভয়ঙ্কর হলো, রাতের আঁধারে তাদের নিরাপত্তা শূন্য। যৌন নির্যাতন, শারীরিক আঘাত বা মাদকে জড়িয়ে যাওয়ার মতো বাস্তবতা তাদের জীবনের অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
অপরাধী নয়, পরিস্থিতির শিকার
আমরা প্রায়শই খবর পাই “পথশিশুর ছিনতাই”, “টোকাইয়ের পকেটমারির চেষ্টা”। কিন্তু ভেবে দেখেছি কি, তারা কেন এমন করে?
তারা জন্ম থেকে অপরাধী নয়। তারা বেড়ে উঠেছে অবহেলার মধ্যে, ভালো-মন্দের কোনো পাঠ ছাড়াই। অপরাধ তাদের পছন্দ নয়, বরং বেঁচে থাকার হাতিয়ার।
সমাজ, পরিবার এবং রাষ্ট্র যদি তাদের সঠিক পথ দেখাতে না পারে, তাহলে তারা পথ হারাবে—এটাই স্বাভাবিক।
চেষ্টা আছে, কিন্তু যথেষ্ট নয়
সরকার ও বেসরকারি কিছু সংস্থা পথশিশুদের নিয়ে কাজ করছে।
- ঢাকা আহসানিয়া মিশন নির্দিষ্ট বয়সসীমার শিশুদের নিয়ে শিক্ষা ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করছে।
- মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনে প্রায় ৪০ হাজার শিশুকে শিক্ষার আলোয় ফেরানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
- কোথাও কোথাও অর্থ সহায়তা দিয়ে স্কুলে ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়া চলছে।
তবে ৩৪ লাখ শিশুর তুলনায় এই উদ্যোগগুলো খুবই সীমিত। স্বেচ্ছাসেবীরা চেষ্টা করছে ঠিকই, কিন্তু এই সংগ্রামে তারা একা। এমন একটি সমস্যা সমাধানে সম্মিলিত অংশগ্রহণ জরুরি।
প্রশ্ন উঠছে—কার দায়িত্ব?
এতোসব বাস্তবতা সামনে রেখে প্রশ্ন জেগে ওঠে, এই ৩৪ লাখ শিশুর দায়িত্ব আসলে কার?
শুধু সরকারের? না, শুধু এনজিওরও না। এটা পুরো সমাজের দায়।
আমরা কেউ শিক্ষক, কেউ ডাক্তার, কেউ ব্যবসায়ী বা সাংবাদিক, কিংবা অন্য যে পেশাইতে থাকি না কেন, যার যার অবস্থান থেকে আমাদের সামান্য কিছু আন্তরিকতাই এই শিশুদের জীবন বদলে দিতে পারে।
কী করণীয়?
১. নিরাপদ আশ্রয়কেন্দ্র: প্রত্যেক জেলা ও উপজেলা শহরে নিরাপদ, পরিচ্ছন্ন এবং শিশু-বান্ধব আশ্রয়কেন্দ্র স্থাপন করতে হবে।
২. বিকল্প শিক্ষা ব্যবস্থা: নিয়মিত স্কুলে পাঠানোর পাশাপাশি কাজের মাঝেও শেখার সুযোগ তৈরি করতে হবে, দিনমজুর শিশুরাও যেন অন্তত লিখতে-পড়তে পারে।
৩. স্বাস্থ্যসেবা ও পুষ্টি: সরকার-এনজিও যৌথভাবে মোবাইল ক্লিনিক চালু করতে পারে। শিশুদের জন্য সাপ্তাহিক পুষ্টিকর খাবার, টিকা ও চিকিৎসা নিশ্চিত করতে হবে।
৪. মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা: নির্যাতিত বা মানসিক আঘাতপ্রাপ্ত শিশুদের জন্য কাউন্সেলিং ও থেরাপি প্রয়োজন, নয়তো তারা বড় হয়ে সমাজের ওপরই রাগ নিয়ে বেড়ে উঠবে।
৫. গণমাধ্যমে সচেতনতামূলক প্রচার: টেলিভিশন, পত্রিকা ও সোশ্যাল মিডিয়ায় এসব শিশুদের নিয়ে ইতিবাচক সচেতনতা তৈরি করতে হবে।
পথশিশুরা সমাজের বোঝা নয়
পথশিশু মানেই অপরাধী বা ব্যর্থ কেউ না। তারা সমাজেরই সন্তান, কেবল সুযোগ না পাওয়ার কষ্ট নিয়ে বেড়ে ওঠা কিছু মুখ।
তাদের হাতে বই থাকতে পারত, কিন্তু আছে রুমাল। তাদের বিছানায় ঘুমাতে হতো, অথচ ঘুমায় ফুটপাথে। তাদের চোখেও ছিল স্বপ্ন, কিন্তু বাস্তবতা সেই স্বপ্ন কেড়ে নিয়েছে।
আজ তারা রাস্তায়। কাল আমাদের সমাজে, আমাদের অফিসে, হাসপাতালের বিছানায় কিংবা আদালতের কাঠগড়ায় হয়তো তারাই থাকবে। এখনই সময়, তাদের পাশে দাঁড়ানোর।
আমরা যদি দায়িত্ব না নেই, তবে কে নেবে?
আমাদের চোখের সামনে বেড়ে ওঠা এই বিশাল সংখ্যক শিশুদের যদি উপেক্ষা করি, তাহলে তাদের ভবিষ্যৎ নয়, আমাদের ভবিষ্যৎও অনিশ্চিত হয়ে যাবে।
দেশের ৩৪ লাখ পথশিশুর দায়িত্ব কে নেবে? আমরাই তো।