ড. ইউনূসের চীন সফর ২০২৫: বাংলাদেশের নতুন কূটনৈতিক কৌশলের সূচনা

ভূ-রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের প্রেক্ষাপট
বিশ্ব কূটনীতির মানচিত্রে প্রতিনিয়ত ঘটছে পরিবর্তন। এক সময়ের একমুখী জোটকেন্দ্রিক পররাষ্ট্রনীতি আজ বিচিত্র ও বহুস্তরীয় কৌশলের পথে হাঁটছে। এমন এক প্রেক্ষাপটে, বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ২৬–২৯ মার্চ চীন সফর নিঃসন্দেহে কেবল একটি আনুষ্ঠানিক রাষ্ট্রীয় সফর নয়, বরং এটি একটি নতুন কূটনৈতিক বাস্তবতার আগমনী বার্তা।
বাংলাদেশ আজ এমন এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে, যেখানে বহুপক্ষীয় অংশীদারিত্ব কেবল কৌশলগত নয়, বরং টেকসই উন্নয়নের পূর্বশর্তে পরিণত হয়েছে। এই সফর ছিল সেই রূপান্তরের একটি সূচনা।
বাংলাদেশ-চীন সম্পর্ক: পুরোনো বন্ধুত্বের নবায়ন
চীন দীর্ঘদিন ধরেই বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠ বন্ধু এবং নির্ভরযোগ্য উন্নয়ন সহযোগী। ১৯৭৫ সালের পরবর্তী সময়ে বেইজিং-এর সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক যে ভিত্তির ওপর গড়ে ওঠে, তা রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামরিক তিন স্তরেই বিস্তৃত। চীন বাংলাদেশের অবকাঠামো খাতে সবচেয়ে বড় বিনিয়োগকারী, পদ্মা সেতুর রেলসংযোগ, কর্ণফুলী টানেল, সিটিংগ্রিড শক্তি প্রকল্পসহ বহু উন্নয়ন প্রকল্পেই চীনের সম্পৃক্ততা রয়েছে।
ড. ইউনূসের এই সফরে সেই সম্পর্ক আরও প্রাতিষ্ঠানিক ও বিস্তৃত রূপ পেল। তবে তাঁর বার্তা ছিল অত্যন্ত সুস্পষ্ট, বাংলাদেশ কাউকে একচেটিয়া জায়গা দিতে চায় না, বরং যে দেশ বাংলাদেশের স্বার্থের পক্ষে কাজ করবে, তার সঙ্গেই বন্ধুত্ব গড়ে তুলবে।
ভারতের প্রতি কূটনৈতিক বার্তা?
বাংলাদেশের দীর্ঘদিনের কৌশলগত মিত্র ভারত। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ের কিছু ঘটনাপ্রবাহ, বিশেষত ভিসা প্রদানে কড়াকড়ি, রাজনৈতিক বক্তব্যে সংযম, এবং পারস্পরিক সফরের অনুপস্থিতি, এমন এক বাস্তবতা তুলে ধরছে যেখানে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক কিছুটা শৈথিল্যের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।
এই অবস্থায় চীন সফর নিছক ‘বিকল্প খোঁজা’ নয়, বরং একটি কৌশলগত ভারসাম্য রক্ষার প্রয়াস। এটি একটি স্পষ্ট বার্তা যে, বাংলাদেশ কেবল ঐতিহ্য বা আবেগের ভিত্তিতে নয়, স্বার্থ ও বাস্তবতার নিরিখে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক পুনঃসংজ্ঞায়িত করছে।
অর্থনৈতিক পুনর্গঠনের পথে চীন
বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে বাণিজ্য ভারসাম্য দীর্ঘদিন ধরেই একমুখী। ২০২৪ সালে চীন বাংলাদেশে প্রায় ২৩ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে, যেখানে বাংলাদেশ রপ্তানি করেছে মাত্র ৬৭৭ মিলিয়ন ডলারের পণ্য। এই বৈষম্য কমাতে ইউনূস প্রশাসন চীনকে আহ্বান জানিয়েছে, বাংলাদেশি কৃষিপণ্য যেমন আম, কাঁঠাল, পেঁপে, পেয়ারার বাজার উন্মুক্ত করতে।
একই সঙ্গে, চীনের লংজি গ্রুপ বাংলাদেশে সৌর প্যানেল কারখানা স্থাপনে আগ্রহ দেখিয়েছে। এর ফলে পুনর্নবীকরণযোগ্য জ্বালানি খাতে প্রযুক্তি হস্তান্তর, কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং দীর্ঘমেয়াদি শিল্প সহযোগিতা গড়ে উঠতে পারে।
মানবিক কূটনীতি ও স্বাস্থ্য সহযোগিতা
সাম্প্রতিক সময়ে ভারতের স্বাস্থ্য পর্যটনে প্রবেশাধিকার সীমিত হওয়ায় বহু বাংলাদেশি রোগী বিকল্প খুঁজছে। চীন এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে ইউনান প্রদেশে বাংলাদেশিদের জন্য তিনটি শীর্ষস্থানীয় হাসপাতাল মনোনয়ন দিয়েছে। এটি একদিকে মানবিক সহানুভূতি, অন্যদিকে ‘সফট পাওয়ার’ কূটনীতির এক নিখুঁত উদাহরণ।
এটি একটি বার্তা, বাংলাদেশ শুধু উন্নয়ন সহযোগিতা নয়, নাগরিক কল্যাণের ক্ষেত্রেও নতুন অংশীদার খুঁজছে।
ভূ-রাজনীতিতে ভারসাম্য রক্ষা: চীন বনাম যুক্তরাষ্ট্র?
একটি বিষয় এখানে গুরুত্বপূর্ণ, চীন সফরের ঠিক আগেই ড. ইউনূস যুক্তরাষ্ট্র সেনাবাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার সঙ্গে বৈঠক করেছেন। এটি প্রমাণ করে, এই সফর কোনো একপাক্ষিক মোড় নেয়নি। বাংলাদেশ চাইছে একটি ব্যালান্সড, বাস্তবভিত্তিক ও কৌশলনির্ভর পররাষ্ট্রনীতি গড়ে তুলতে। বঙ্গবন্ধুর সেই ঐতিহাসিক নীতিকে আধুনিকায়ন করে বলা যায় “সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারো সঙ্গে বৈরিতা নয়” এই সরকারের মূল দর্শন।
চীন এবং যুক্তরাষ্ট্র উভয়ের সঙ্গেই সম্পর্ক রেখে চলা একটি চ্যালেঞ্জ, তবে একই সঙ্গে এটি কৌশলগত সক্ষমতার প্রমাণ।
রোহিঙ্গা সংকট ও চীনের প্রভাব
বাংলাদেশের জন্য রোহিঙ্গা সংকট একটি দীর্ঘস্থায়ী মানবিক ও রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ। মিয়ানমারের ওপর চীনের ঐতিহাসিক প্রভাব এবং অতীতে মধ্যস্থতার ভূমিকা ভবিষ্যতেও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। ড. ইউনূস এই সফরে বিষয়টি চীনা কর্তৃপক্ষের সামনে উত্থাপন করেছেন, যা প্রমাণ করে, বাংলাদেশ এই ইস্যুতে শুধু মানবিক আবেদন নয়, কৌশলগতভাবে জোরালো অবস্থান নিতে প্রস্তুত।
আঞ্চলিক নেতৃত্বে বাংলাদেশ?
চীন সফরের অংশ হিসেবে ড. ইউনূস বোয়াও ফোরামে অংশগ্রহণ করেন। এটি কেবল একটি আঞ্চলিক সম্মেলন নয়, বরং এশিয়ার ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব এবং অংশীদারিত্ব নিয়ে উচ্চপর্যায়ের সংলাপের মঞ্চ। সেখানে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ কেবল একটি উন্নয়নশীল দেশের অংশগ্রহণ নয়, বরং নেতৃত্বের জন্য প্রস্তুত একটি জাতির ঘোষণা।
বাংলাদেশ এখন চাইছে কেবল সাহায্যপ্রার্থী হতে নয়, বরং সমস্যা সমাধানে অংশগ্রহণকারী এবং ভবিষ্যৎ কূটনীতির কাঠামো নির্মাণে সক্রিয় অংশীদার হতে।
এক নতুন পথের সূচনা
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের এই চীন সফর নিঃসন্দেহে বাংলাদেশ-চীন সম্পর্কের একটি নতুন মাত্রা তৈরি করেছে। তবে এটি কেবল একটি দ্বিপাক্ষিক অগ্রগতি নয় বরং বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির রূপান্তরের ইঙ্গিত। এটি ভবিষ্যতের পথে একটি কৌশলগত সেতুবন্ধন।
বিশ্ব এখন আর ব্লক বা জোটভিত্তিক নয়, বরং বহু-মেরু বাস্তবতায় প্রবেশ করছে। বাংলাদেশ যদি নিজের জাতীয় স্বার্থ, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং কৌশলগত নিরাপত্তাকে সামনে রেখে এগোয়, তবে এই সফর হতে পারে একটি টার্নিং পয়েন্ট, একটি নতুন দৃষ্টিভঙ্গির সূচনা।
এখন সময় আবেগ নয়, বাস্তবতাকে গুরুত্ব দেওয়ার। বাংলাদেশ কেবল অনুসারী নয়, নেতৃত্বের পথে হাঁটতে চায়।
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের চীন সফরের প্রধান উদ্দেশ্য কী ছিল?
ড. ইউনূসের চীন সফরের মূল উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশ-চীন কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক আরও শক্তিশালী করা, নতুন বিনিয়োগের সুযোগ সৃষ্টি করা, কৃষিপণ্যের বাজার সম্প্রসারণ এবং আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক ফোরামে বাংলাদেশের নেতৃত্বমূলক ভূমিকা প্রতিষ্ঠা করা।
চীন সফরের মাধ্যমে বাংলাদেশের কোন খাতে উন্নতির সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে?
চীন সফরের মাধ্যমে অবকাঠামো উন্নয়ন, নবায়নযোগ্য জ্বালানি (সৌর প্যানেল কারখানা), কৃষিপণ্যের রপ্তানি বৃদ্ধি, স্বাস্থ্যসেবা সহায়তা এবং শিল্প সহযোগিতার নতুন সুযোগ তৈরি হয়েছে।