
বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সূচক হলো বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। রিজার্ভ শুধু পরিসংখ্যান নয়, এটি একটি দেশের আর্থিক সক্ষমতা, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও বৈদেশিক আস্থার প্রতীক। ২০২২ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত রিজার্ভের ধস অনেককেই আশঙ্কায় ফেলেছিল। তখন অনেকে প্রশ্ন তুলেছিলেন, বাংলাদেশ কি শ্রীলঙ্কার পথেই হাঁটছে? কিন্তু ২০২৫ সালের এপ্রিলের শুরুতে দেখা যাচ্ছে, রিজার্ভ আবারও ঘুরে দাঁড়াচ্ছে।
সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ২৬.৫১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা কয়েক মাস আগেও ছিল ১৯.৭০ বিলিয়ন ডলারে। এই ইতিবাচক পরিবর্তনের পেছনে রয়েছে সরকারের কিছু গুরুত্বপূর্ণ, কার্যকর ও সুপরিকল্পিত সিদ্ধান্ত।
রিজার্ভ পতনের প্রেক্ষাপট কী ছিল?
২০২২ সালের আগস্টে বাংলাদেশের রিজার্ভ ছিল সর্বোচ্চ ৪৮.০৬ বিলিয়ন ডলার। তবে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, বিশ্বব্যাপী জ্বালানি সংকট, হুন্ডির মাধ্যমে রেমিট্যান্স পাচার, অতিরিক্ত আমদানি ব্যয় এবং রপ্তানির মন্দা পরিস্থিতি রিজার্ভকে ক্রমেই সংকটের দিকে ঠেলে দেয়।
বিশ্বব্যাপী মূল্যস্ফীতি ও ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন আমদানি খরচ বাড়িয়ে দেয়। একই সময়ে বৈদেশিক ঋণের কিস্তি পরিশোধ, আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁচামালের দাম বৃদ্ধি এবং আমদানি বিল পরিশোধের চাপ রিজার্ভকে আরো দুর্বল করে তোলে।
২০২৩ সালের মাঝামাঝি এই রিজার্ভ নেমে আসে মাত্র ২০.৩৯ বিলিয়ন ডলারে। ফলে আমদানি এলসি (LC) বন্ধ হয়ে যেতে থাকে, ডলারের বাজারে অস্থিরতা দেখা দেয়, এবং দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আস্থা ক্ষুণ্ন হয়। রিজার্ভ কমার প্রভাব পড়ে ভোগ্যপণ্যের দামে, আমদানি-নির্ভর শিল্পে, এমনকি ওষুধ শিল্পেও।
রিজার্ভ বাড়াতে অন্তবর্তীকালীন সরকারের কৌশলগত সিদ্ধান্ত
বর্তমান সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ফেরানোর লক্ষ্যে কিছু দূরদর্শী সিদ্ধান্ত নেয়। সেগুলোর মধ্যে প্রধান কয়েকটি ছিল:
- কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ডলার বিক্রি বন্ধ করা
- বিপরীতে, বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে ডলার কেনা শুরু করা
- হুন্ডি বন্ধে কঠোর বার্তা ও পদক্ষেপ
- রেমিট্যান্সে প্রণোদনা এবং নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ
- এলসি খোলায় স্বচ্ছতা ও নিয়ন্ত্রণ বৃদ্ধি
সরকার চায়, অর্থনৈতিক সংকট শুধু তাৎক্ষণিকভাবে সামাল না দিয়ে একটি দীর্ঘমেয়াদি সমাধান তৈরি করতে। এসব পদক্ষেপের ফলে রেমিট্যান্স প্রবাহ বেড়েছে, রপ্তানিতে গতি ফিরেছে এবং রিজার্ভ স্বাভাবিকভাবে পুনরুদ্ধার হচ্ছে।
ইতিহাস গড়ার পথে রেমিট্যান্স
২০২৫ সালের মার্চ মাসে প্রবাসী আয় এসেছে ৩২৯ কোটি মার্কিন ডলার, এটি বাংলাদেশের ইতিহাসে এক মাসে সর্বোচ্চ রেমিট্যান্স। এই সাফল্য হঠাৎ আসেনি। সরকারের নীতিনির্ধারকরা হুন্ডি প্রতিরোধে একটি স্পষ্ট ও কঠোর বার্তা দেন।
প্রবাসীরা এখন যদি জমি বা ফ্ল্যাট কেনেন, তাদের অর্থের উৎস ব্যাখ্যা করতে হয়। এই উদ্যোগ ব্যাংকিং চ্যানেলে টাকা পাঠাতে মানুষকে বাধ্য করছে। সেই সঙ্গে রেমিট্যান্স পাঠানোর প্রক্রিয়াকে আরও সহজ, দ্রুত এবং স্বচ্ছ করা হয়েছে।
এছাড়া, বিভিন্ন দেশে প্রবাসী বাংলাদেশিদের জন্য অ্যাম্বাসি ও হাইকমিশনের মাধ্যমে সচেতনতামূলক কার্যক্রম চালানো হয়েছে যাতে তারা হুন্ডির পরিবর্তে বৈধ পথে টাকা পাঠান।
রপ্তানি প্রবৃদ্ধি: সংকট থেকে সম্ভাবনায়
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্যমতে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের মার্চ মাসে রপ্তানি বেড়ে দাঁড়ায় ৪.২৫ বিলিয়ন ডলার, যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ১১.৪৪% বেশি।
পোশাকশিল্প তো বটেই, এখন তথ্যপ্রযুক্তি ও চামড়া শিল্পেও রপ্তানির প্রসার ঘটছে। ভারত, চীন ও ইউরোপ ছাড়াও নতুন বাজারে প্রবেশের কূটনৈতিক প্রচেষ্টা ফল দিতে শুরু করেছে।
সরকারের শিল্পনীতি, প্রণোদনা, এলসি ব্যবস্থাপনার স্বচ্ছতা এবং ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ রপ্তানিকারকদের নতুন আত্মবিশ্বাস জুগিয়েছে। এসব উপাদানই মিলে দেশের বৈদেশিক আয় বাড়াতে ভূমিকা রাখছে।
ব্যাংকিং খাতে স্বচ্ছতা ও রিজার্ভ ব্যবস্থাপনায় কৌশল
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান সম্প্রতি বলেছেন:
“রপ্তানি বেড়েছে, আমদানি নিয়ন্ত্রিত, এবং প্রবাসী আয় রেকর্ড ছুঁয়েছে, এই তিনটি উপাদানই রিজার্ভ বৃদ্ধির মূল চালিকাশক্তি।”
এখন ব্যাংকগুলো আগের মতো এলসি খুলে খরচ বাড়াতে পারছে না। কঠোর যাচাই-বাছাইয়ের মাধ্যমে এলসি অনুমোদন নিশ্চিত করা হচ্ছে। সেই সঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রতিটি আমদানি বিলের পেছনে প্রয়োজনীয়তা ও বৈধতা নিশ্চিত করছে।
ব্যাংকগুলোও রেমিট্যান্স আহরণে নতুন নতুন অফার, এক্সচেঞ্জ রেট সুবিধা ও ডিজিটাল অ্যাপ চালু করছে। এতে করে প্রতিযোগিতা বাড়ছে এবং প্রবাসীরা আগ্রহ পাচ্ছেন ব্যাংকিং চ্যানেল ব্যবহার করতে।
চ্যালেঞ্জ এখনো বিদ্যমান: কীভাবে সমাধান?
শাহাজালাল ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোসলেহ উদ্দীন আহমেদ বলেছেন:
“রপ্তানি ও রেমিট্যান্স বৃদ্ধি এবং হুন্ডি কমার কারণে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বেড়েছে। তবে এখনো ডলারের ওপর চাপ আছে। বিদেশি ঋণ পরিশোধের চাপ রয়েছে।”
আগামী মাসে প্রায় ১.৫ বিলিয়ন ডলার আকু পেমেন্টের কারণে রিজার্ভ আবার কিছুটা কমতে পারে। তবে আগের মতো হঠাৎ বিপর্যয়ের সম্ভাবনা এখন অনেক কম।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দীর্ঘমেয়াদে যদি রপ্তানি আয় ও প্রবাসী আয়ের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করা যায় এবং বৈদেশিক ঋণের ওপর নির্ভরতা কমানো যায়, তাহলে রিজার্ভ আরও শক্তিশালী হবে।
ভবিষ্যতের জন্য করণীয়: এই ধারা অব্যাহত রাখতে যা দরকার
- রপ্তানি বৈচিত্র্য ও নতুন বাজারে প্রবেশ
- ডিজিটাল মাধ্যমে রেমিট্যান্স সহজীকরণ ও ইনসেনটিভ
- ব্যাংক খাতে জবাবদিহি ও দুর্নীতি দমন
- বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে কূটনৈতিক ও নীতি সহায়তা
- বাজেট ঘাটতি কমিয়ে নিজস্ব রিজার্ভে নির্ভরতা বাড়ানো
- রিজার্ভ ব্যবস্থাপনায় আধুনিক প্রযুক্তি ও স্বয়ংক্রিয়তা আনা
বিশ্ববাজারের ওঠানামা, ভূরাজনৈতিক টানাপোড়েন ও জলবায়ু পরিবর্তনের মতো বৈশ্বিক ঝুঁকি মোকাবেলায় দেশের অর্থনীতিকে লচকদার ও সহনশীল করতে হলে এসব উদ্যোগ নিতে হবে এখন থেকেই।
আস্থার পথে বাংলাদেশ
রিজার্ভ পুনরুদ্ধার শুধু একটি গাণিতক সংখ্যা নয়, এটি সরকারের সুশাসন, পরিকল্পনা, ও বাস্তবায়নের প্রতিচ্ছবি। বৈদেশিক ঋণ ও বিশ্বব্যবস্থার চাপে থেকেও যখন একটি দেশ তার মুদ্রা ভাণ্ডার বাড়াতে সক্ষম হয়, তখন সেটিকে কেবল অর্থনৈতিক নয়, কৌশলগত অর্জনও বলা যায়।
সরকারের এই ইতিবাচক পদক্ষেপগুলো দেশের অর্থনীতি ও আন্তর্জাতিক আস্থার জন্য নতুন এক অধ্যায় রচনা করছে। এখন দরকার এই ধারাবাহিকতা বজায় রাখা, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষা এবং দীর্ঘমেয়াদি কৌশল প্রণয়ন।
বাংলাদেশের ফ্রিল্যান্সিং খাত, আইটি রপ্তানি এবং ডিজিটাল উদ্যোক্তাদের বৈদেশিক আয় বৃদ্ধির মাধ্যমে রিজার্ভে ইতিবাচক প্রভাব ফেলছে। তবে এখনো গুরুত্বপূর্ণ কিছু আর্থিক সেবা যেমন পেপ্যাল চালু না হওয়ায় অনেক সম্ভাবনার অপচয় হচ্ছে। বিস্তারিত জানতে পড়ুন: বাংলাদেশে পেপ্যাল চালু হবে কবে? জানুন গুরুত্ব ও সম্ভাবনা