akramhossaincf.com

রাফাহর ধ্বংসস্তূপ ও গাজার আর্তনাদ | মুসলিম উম্মাহর নীরবতা কেন?

২০২৫ সালের রাফাহ। ধ্বংসস্তূপে চাপা পড়ে আছে একটি জাতির কফিন। বাতাসে ভাসছে পুড়ে যাওয়া ঘরের ধোঁয়া, শিশুদের কান্না, আর মায়ের হৃদয়বিদারক আহাজারি। অথচ চারপাশে নিস্তব্ধতা। মুসলিম উম্মাহর অন্তরেও যেন এক বিবেকহীন নীরবতা।
কীভাবে সম্ভব? কীভাবে সম্ভব একটি জাতিকে দিনের পর দিন হামলা চালিয়ে বিলীন করে  দেওয়া হচ্ছে, অথচ আমরা শুধুই “নিন্দা” জানিয়ে দায় সারছি?

২০২৫ সালের মার্চ ও এপ্রিলজুড়ে ইসরাইলি আগ্রাসনের সর্বশেষ রূপ আমরা দেখেছি রাফাহে। জাতিসংঘ বারবার হুঁশিয়ারি দেওয়ার পরেও প্রায় ১২ লক্ষ মানুষকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে একপ্রকার গণকবরের দিকে।
ফিলিস্তিনি রেড ক্রিসেন্ট জানিয়েছে—স্রেফ এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহেই ৫০০-এর বেশি শিশু নিহত হয়েছে। স্কুল, হাসপাতাল, রিলিফ ক্যাম্প—কোনো কিছুই রেহাই পায়নি।
আর এইসব হামলা হয়েছে মার্কিন সমর্থনপুষ্ট অস্ত্রে, ইউরোপীয় নীরবতার ছায়ায়, আর মুসলিম নেতাদের মুখোশধারী নিষ্ক্রিয়তায়।

ইতিহাসের পেছনের কুৎসিত মুখ

ফিলিস্তিনের এই বিপর্যয় আজকের নয়। এটি এক দীর্ঘ ষড়যন্ত্রের পরিণতি, যার সূচনা বিংশ শতাব্দীর শুরুতে।
পশ্চিমা উপনিবেশবাদীরা উসমানী খেলাফতের পতনের জন্য লেলিয়ে দেয় সাহ্যোনিয়্যাত নামক ঘৃণ্য একটি রাজনৈতিক আন্দোলনকে। হার্জেল ও রথচাইল্ডের মতো ইহুদি বণিকরা ফিলিস্তিনের জমি ক্রয়ের নামে মুসলিমদের সঙ্গে প্রতারণা করে।

১৮৯৭ সালে প্রথম জায়নিস্ট কংগ্রেস ঘোষণা দেয় ‘গ্রেটার ইসরাইল’ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন।
১৯১৭ সালের বেলফোর ঘোষণার মাধ্যমে ব্রিটেন এই প্রকল্পকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয়।
আর উসমানী খলিফা দ্বিতীয় আব্দুল হামিদের এক অস্বীকৃতি—”আমি ফিলিস্তিনের এক মুঠো মাটিও বিক্রি করব না”—ছিল মুসলিম আত্মমর্যাদার শেষ গর্জন।

কাশ্মীর ও ফিলিস্তিন—একই চক্রান্তের ভিন্ন রূপ

ফিলিস্তিন ও কাশ্মীর—ভিন্ন ভৌগলিক প্রেক্ষাপটে হলেও চক্রান্ত এক এবং অভিন্ন।
ভারত কাশ্মীরে যা করেছে, ইসরাইল ফিলিস্তিনে তাই করছে—জমি দখল, জনগণকে উৎখাত, গণহত্যা, এবং মুসলমানদের আত্মপরিচয় মুছে ফেলা।

আন্তর্জাতিক বিশ্ব?
তারা কেবল “উভয়পক্ষের শান্তি” খোঁজে। অথচ বাস্তবে এক পক্ষকে দিচ্ছে ট্যাঙ্ক, হেলিকপ্টার আর ফসফরাস বোমা, আরেক পক্ষকে হাতে ধরিয়ে দিচ্ছে মোমবাতি আর শোক।

উম্মাহর ভগ্নদশা ও মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর নিষ্ক্রিয়তা

সবচেয়ে বেদনাদায়ক বিষয়—মুসলিম বিশ্বের নৈতিক ও রাজনৈতিক ব্যর্থতা।
পাকিস্তান, যার সেনাবাহিনীর স্লোগানেই “ইমান, তাকওয়া, জিহাদ”—তারা ব্যস্ত অভ্যন্তরীণ ষড়যন্ত্রে।
মিশর, যে গাজা সীমান্ত ঘিরে রেখেছে কাঁটাতারে, তারা যেন আজ ইসরাইলের এক প্রকার উপনিবেশিক পাহারাদার।

২০২৫ সালের রাফাহে যখন আগুনে পুড়ে শিশুর হাড়ও চেনা যাচ্ছিল না, তখন সৌদি আরব ব্যস্ত ছিল খেলাধুলার উৎসব নিয়ে। আর সংযুক্ত আরব আমিরাত তখন নতুন ‘শান্তি চুক্তি’র নামে ইসরাইলের সঙ্গেই আলিঙ্গন করছিল। এই নির্লজ্জ নিরবতা ইতিহাস কোনোদিন ক্ষমা করে না।

গাজার প্রতিরোধ—এক মহাকাব্যিক অধ্যায়

গাজার মানুষ, যারা প্রতিনিয়ত বোমা খাচ্ছে, তাদের হৃদয়ের সাহস যেন পাহাড়কেও লজ্জা দেয়।
তাদের হাতে পাথর, সামনে ট্যাঙ্ক। তাদের পিঠে ক্ষুধা, কিন্তু কণ্ঠে “আল্লাহু আকবার”।
এই মৃত্যু তাদের জন্য শহাদাত, আর আমাদের জন্য চরম লজ্জা।হামাস—শুধু একটি সংগঠন নয়, এটি এক বিশ্বাসের নাম। তারা আয়রন ডোমের প্রতিরোধ ভেঙে যে ক্ষেপণাস্ত্র ছুঁড়েছে, তা কেবল ইসরাইলের বুকে নয়, বরং উম্মাহর ঘুমন্ত হৃদয়ে এক ঝাঁকুনি। ২০২৫ সালে, যখন গাজার প্রায় অর্ধেক ধ্বংসপ্রাপ্ত, তখনো হামাস এখনো থেমে নেই। তারা শুধু অস্ত্র নয়—আস্থা, আত্মত্যাগ আর শাহাদাতের ওপর বিশ্বাস নিয়ে এগিয়েছে।

ইসলামের আলোকে মানবাধিকার ও সত্য

ইহুদি, খ্রিস্টান বা অন্যান্য ধর্মাবলম্বী—যারা মুসলিমদের অধীনে বসবাস করেছে, তারা পায়নি কোনো নিপীড়ন, বরং নিরাপত্তা।  রাসূল (সা.) মদিনার চুক্তিতে ইহুদিদের পূর্ণ নাগরিক অধিকার দিয়েছিলেন।আজ যারা “ইহুদি বিদ্বেষ” বা “ইসলামোফোবিয়া”র দোহাই দিয়ে সত্য চাপা দিতে চায়, তারা ইতিহাস অস্বীকার করছে।ফিলিস্তিনিরা শুধু মুসলমান নয়—তারা ঐ ভূমির প্রকৃত অধিবাসী।
তাদের জমি, রক্ত, মর্যাদা—সবকিছুর ওপর রয়েছে জন্মগত অধিকার।

আমরা কী করতে পারি?

আমাদের করণীয় এখন আর বিতর্কের বিষয় নয়—এটি অস্তিত্বের প্রশ্ন। প্রথমত, আমাদের ঘর থেকেই শুরু করতে হবে সচেতনতা। পরিবার, বন্ধুবান্ধব ও কর্মপরিসরে সত্যটি তুলে ধরতে হবে। সোশ্যাল মিডিয়ায় বিভ্রান্তিমূলক প্রচারণার বিপরীতে সত্যিকারের তথ্য ছড়িয়ে দিতে হবে। দ্বিতীয়ত, যারা ইসরাইলি আগ্রাসনের সরাসরি বা পরোক্ষ পৃষ্ঠপোষক—তাদের পণ্য বর্জন করতে হবে। এটি নিছক কোনো কেনাকাটার সিদ্ধান্ত নয়—এটি একটি নৈতিক অবস্থান, একটি প্রতিবাদের ভাষা। তৃতীয়ত, আমাদের ঈমানি সংযোগ জাগ্রত করতে হবে। কুরআন পড়তে হবে, নামাজে কাঁদতে হবে, শহীদদের জন্য দুআ করতে হবে। দুঃখিত হওয়ার চেয়ে সংযুক্ত থাকা গুরুত্বপূর্ণ—মানসিক ও আত্মিকভাবে। আর সর্বোপরি, আমাদের সরকার ও জনপ্রতিনিধিদের প্রতি চাপ সৃষ্টি করতে হবে। তাদের জানাতে হবে—এই বর্বরতার প্রতি নিরবতা কোনো বিকল্প নয়। আমাদের প্রস্তাব, আমাদের দাবি, আমাদের প্রতিবাদই তাদের নিরবতা ভাঙতে বাধ্য করতে পারে। এখনই সময় ঘুম ভাঙানোর, এখনই সময় বিবেক জাগানোর।

ঘুম ভাঙুক, নয়তো ইতিহাস আমাদের ক্ষমা করবে না

রাফাহর ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়া প্রতিটি শিশুর আর্তনাদ আমাদের অন্তরে পৌঁছায় কি?
গাজার অর্ধ-ক্ষুধার্ত মা যখন মৃত সন্তানকে বুকে জড়িয়ে থাকে, তখন আমাদের অন্তর কাঁপে কি না?

যদি আজ আমরা নিরব থাকি, তবে ইতিহাস আমাদের সাহাবিদের উম্মত নয়—বরং ইবনে আলকমা ও আবু রুগাহর মতো বিশ্বাসঘাতকদের উত্তরসূরি হিসেবেই মনে রাখবে। কারণ ফিলিস্তিন শুধু একটি ভূখণ্ড নয়—এটা একটি আত্মপরিচয়ের নাম, একটি উম্মাহর ইজ্জতের প্রতীক।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top