
ছাত্র রাজনীতি—একসময় যা ছিল মুক্তচিন্তা, অধিকার আদায় এবং নেতৃত্ব তৈরির প্ল্যাটফর্ম, আজ তা অনেক ক্ষেত্রে সহিংসতা, লেজুড়বৃত্তি ও দলীয় স্বার্থরক্ষার যন্ত্রে পরিণত হয়েছে। দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে একের পর এক সংঘর্ষ, দখলদারিত্ব ও সহিংস রাজনীতির কারণে সাধারণ শিক্ষার্থীরা রাজনীতিকে ভয় পেতে শুরু করেছে। কিন্তু এই রাজনীতি যদি সুস্থ ধারায় পরিচালিত হয়, তবে এটি হতে পারে দেশের ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব তৈরির অন্যতম মাধ্যম।
শিক্ষাঙ্গনে ছাত্র রাজনীতির বর্তমান চিত্র
জুলাই-আগস্টের ছাত্র আন্দোলনের পর শিক্ষার্থীদের মধ্যে নতুন আশার সৃষ্টি হয়েছিল। ছাত্র- জনতা সকলেই ভেবেছিল, এবার হয়তো ছাত্র রাজনীতির একটি গঠনমূলক রূপ দেখা যাবে। কিন্তু খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (কুয়েট) সহ দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে সংঘর্ষ ও দাঙ্গার ঘটনায় সেই আশা ক্রমশ ফিকে হয়ে যাচ্ছে। কুয়েটের সাম্প্রতিক সহিংস ঘটনায় প্রকাশ্যে অস্ত্রের ব্যবহার এবং রাজনৈতিক গোষ্ঠীর হস্তক্ষেপ ছাত্র রাজনীতির এক নতুন সংকটকে সামনে এনেছে। ফলস্বরূপ, কুয়েট প্রশাসন ক্যাম্পাসে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করেছে।
কিন্তু প্রশ্ন হলো—ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করাই কি সমাধান? নাকি এটিকে সুস্থ ধারায় ফিরিয়ে আনাই হবে সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত?
রাজনৈতিক সহিংসতা: শিক্ষার্থীদের জন্য অভিশাপ
একসময় ছাত্র রাজনীতি ছিল একটি আদর্শবাদী চর্চা, যেখানে নেতৃত্ব গঠনের পাশাপাশি সামাজিক ও জাতীয় ইস্যুগুলোর প্রতি শিক্ষার্থীদের দায়িত্ববোধ গড়ে উঠত। কিন্তু এখন এটি অনেক ক্ষেত্রেই ক্ষমতা দখল, স্বার্থ আদায় এবং সহিংসতায় পরিণত হয়েছে। রাজনৈতিক দলের প্রভাবশালী নেতাদের ছত্রছায়ায় কিছু ছাত্র সংগঠন ক্যাম্পাসে আধিপত্য বিস্তার করতে চায়, যার ফলে সাধারণ শিক্ষার্থীরা প্রতিনিয়ত হয়রানি ও সহিংসতার শিকার হচ্ছে।
কীভাবে ফিরিয়ে আনা যায় সুস্থ ছাত্র রাজনীতি?
১. ছাত্র সংসদ নির্বাচন চালু করা:
বর্তমানে দেশের প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচন বন্ধ রয়েছে। এর ফলে শিক্ষার্থীদের অধিকার রক্ষার জন্য কোনো নিরপেক্ষ ছাত্র প্রতিনিধি নেই। ছাত্র সংসদ নির্বাচন বাধ্যতামূলক করলে শিক্ষার্থীরা নিজেদের প্রতিনিধি নির্বাচন করতে পারবে এবং দলীয় স্বার্থের বাইরে গিয়ে শিক্ষার্থীদের সমস্যা সমাধানে ভূমিকা রাখতে পারবে।
২. দলীয় প্রভাবমুক্ত শিক্ষাঙ্গন:
বিশ্ববিদ্যালয় হলগুলোতে প্রশাসনের নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে হবে। বর্তমানে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার থাকায় হলগুলো প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণে থাকলেও ভবিষ্যতে দলীয় রাজনীতি পুনরায় প্রভাব বিস্তার করতে পারে। তাই শিক্ষার্থীদের অধিকার নিশ্চিত করতে দলীয় হস্তক্ষেপ রোধ করা জরুরি।
৩. সহাবস্থান ও সম্প্রীতির পরিবেশ:
ছাত্র রাজনীতিতে একক আধিপত্যের পরিবর্তে বিভিন্ন সংগঠনের মধ্যে বোঝাপড়া, সহাবস্থান এবং পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ গড়ে তুলতে হবে। শিক্ষাঙ্গনে সহিংসতা, দখলদারিত্ব ও চাঁদাবাজির পরিবর্তে শিক্ষার্থীদের কল্যাণে নীতিনির্ধারণী আলোচনা ও কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে।
৪. আদর্শিক রাজনীতি ও নেতৃত্ব গঠন:
ছাত্র রাজনীতিকে হতে হবে আদর্শনির্ভর। যেখানে নেতৃত্ব আসবে মেধা ও সততার ভিত্তিতে, স্বার্থান্বেষীদের মাধ্যমে নয়। শিক্ষার্থীদের কল্যাণে কাজ করাই হবে ছাত্র সংগঠনের মূল লক্ষ্য।
সুস্থ ছাত্র রাজনীতি চাই, লেজুড়বৃত্তি নয়
শিক্ষাঙ্গনে সুস্থ রাজনীতি চর্চার জন্য প্রয়োজন ইতিবাচক পরিবর্তন। লেজুড়বৃত্তির ছাত্র রাজনীতি শুধু শিক্ষার্থীদের ক্ষতিগ্রস্ত করে না, বরং দেশের ভবিষ্যৎ নেতৃত্বকেও দুর্বল করে দেয়। রাজনৈতিক দলগুলোকেও বুঝতে হবে যে, তাদের ছাত্র সংগঠন যদি সন্ত্রাসের পথে হাঁটে, তবে সেটি তাদের ভবিষ্যৎ নেতৃত্বের জন্যও ক্ষতিকর। তাই এখনই সময় সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার—আমরা সত্যিকারের শিক্ষার্থীবান্ধব রাজনীতি চাই, নাকি আগের মতো সহিংসতা ও লেজুড়বৃত্তির রাজনীতি বহাল রাখতে চাই?
শিক্ষার্থীদের অধিকার রক্ষার জন্য এবং শিক্ষাঙ্গনে একটি নিরাপদ ও সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করতে সুস্থ ছাত্র রাজনীতি প্রতিষ্ঠার কোনো বিকল্প নেই। সময় এসেছে শিক্ষার্থী, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও রাজনৈতিক দলগুলোর একসঙ্গে কাজ করার, যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি উন্নত, নিরাপদ এবং গণতান্ত্রিক শিক্ষাঙ্গন তৈরি করা যায়।
অত্যন্ত সময়োপযোগী লেখা। ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করা কোনো সমাধান নয়, বরং সেটিকে সুস্থ ধারায় ফিরিয়ে আনা উচিত। সুস্থ ছাত্র রাজনীতি ফিরিয়ে আনা এখন সময়ের দাবি।